বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সামনে এবার একটা বড় সুযোগ এসেছে নিজের ঘর পরিষ্কার করার। কোটা আন্দোলনের সূত্রপাত, ষড়যন্ত্র, আওয়ামী নেতাদের অতিকথন ও অদূরদর্শিতার কারনে রাষ্টের গায়ে যে আঘাত লেগেছে তার ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ। যাদের হাত ধরে অনুপ্রবেশ ঘটেছে আওয়ামী রাজনীতিতে এদের সারা জীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হোক। আওয়ামী লীগের অতিত রাজিনীতি বিশ্লেষন করলে দেখা যাবে এই দলটি সব সময়ই জনমানুষের পালস বুঝে রাজনীতি করেছে। ২০১৪-এর পর সেই আওয়ামী লীগ এর রাস্তা কেন উল্টোপথে, তারা কেন উল্টো পথে হাঁটছে?
মূল দল সহ এর সকল সহযোগী ও অঙ্গ-সংগঠনের কোথাও ডেডিকেশনের কোনো মূল্য নেই। যে যত বড় তেলবাজ তার তত বড় পোস্ট।
যদি প্রশ্ন করি তান্ডবের কয়েকটা দিন পুরো ঢাকা শহরের আওয়ামী লীগের এমপি এবং নেতারা কোথায় ছিলেন? এই সরকারের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগীরা কেন রাতারাতি চোখ পাল্টি নিল?
ঘোষণা দিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করে লাখ লাখ সাইবার যোদ্ধা বানানো হলো তারা সব কোথায় হাওয়া হয়ে গেল! অনলাইন, অফলাইন কোনো কিছুই আওয়ামী লীগের দখলে নেই। গত ১৬ বছরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ। কোথাও কোনো সাংগঠনিক চর্চা নেই। থানায় থানায় জেলায় জেলায় নিজস্ব বলয়, যার অধিকাংশই সুবিধাভোগী এবং অনুপ্রবেশকারী দিয়ে ভরা। দল এবং সরকারে প্রতিটা ধাপে ত্যাগী এবং পরীক্ষিতরা বঞ্চিত। সেটার ফল হাতে হাতে পেল আওয়ামী সরকার। তবে আওয়ামীলীগ এই অবস্থা থেকে উত্তরনের সক্ষমতা রাখে কিন্তু এর থেকে যদি শিক্ষা না নেয় তাহলে সামনে আরও কঠিন দুঃসময় অপেক্ষা করছে। এবারও কিছু আবেগী এবং আমার মত বেহায়া মানুষ আওয়ামী লীগের পক্ষে রাজপথে এবং অনলাইনে যুদ্ধ করেছে। ভুল থেকে শিক্ষা না নিলে পরের বার আওয়ামী লীগ কাউকে পাশে পাবে না। নেতা বানানোর সময় সবচেয়ে লোভী, তেলবাজ এবং অযোগ্যকে বেছে নেওয়া হয়। বঞ্চিত করা হয় সবচেয়ে পরীক্ষিত, যোগ্য এবং পরিশ্রমী কর্মীকে।
এবার আসি সরকারি বিভিন্ন চেয়ার প্রসঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর কাদের বানানো হয়? এবারের এ অস্থিরতায় কোনো ভাইস চ্যান্সেলরের সাহসী ভূমিকা কি জনগন দেখেছে? প্রত্যেকেই তার চেয়ার বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলেন। দল, সরকার জাহান্নামে যাক কিন্তু চেয়ার বেঁচে থাক। অথচ দলীয় পরিচয়েই প্রত্যেকে চেয়ারে বসেছেন।
দেশে এত এত সংস্থা। গত কয়েকদিন ধরে লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় ঢুকল সেই তথ্য কেন কারও কাছে ছিল না? সঠিক তথ্য থাকলে এতগুলো প্রাণ ঝরত না। রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপূরণীয় এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতিও এড়ানো যেত। কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিকদের এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মহাখালীতে অগ্নিসংযোগের ঘটনার কথা তুলে ধরে ডিবিসি সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, বেলা ৩টার পর সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য ছিলেন না। আমি নিজেও সেখানে বিকাল তিনটা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত ছিরাম আমা্র প্রশ্ন, ‘কেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্য সেখানে ছিলেন না এবং কেন একজন কর্মকর্তা তাঁর বাহিনী নিয়ে জায়গা ছেড়ে চলে গেলেন?’ গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল এবং সে কারণেই পুলিশ রাজধানীর আশপাশে চেকপোস্ট বসায়। একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, রাজধানীতে কোনো পিঁপড়া প্রবেশ করতে পারবে না, অথচ হাতির পাল প্রবেশ করেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। নিজেদের কর্মকান্ডের জন্য আত্মসমালোচনা করা উচিত, গত ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের অফিস রক্ষায় কেন সেনাবাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রয়োজন পড়ল।
দেশে আইসিটি নামে একটা মন্ত্রণালয় আছে। সেই মন্ত্রণালয়ের কাজটা কী? গত ১০ বছরে আইসিটি মন্ত্রণালয়ে কারা কাজ করেছে তার একটা তালিকা প্রকাশ করা হোক। অনলাইন প্ল্যাটফরমটা কেন এতটা অনিরাপদ হলো? এর দায় কার? প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। দেশটা ডিজিটাল করলেন আপনি অথচ তার সুফল কেন অন্যরা ভোগ করছে! গুজব প্রতিরোধে কী ভূমিকা রেখেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়? আইসিটি মন্ত্রণালয় এত বছর যাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে প্রত্যেকেই এক একটা গুজবের ফ্যাক্টরি। আইসিটি সেক্টরের পুরো নিয়ন্ত্রণ জামায়াত-বিএনপির হাতে। কোথাও কোনো জবাবদিহিতা নেই।
একটা বিষয় জাতির সামনে পরিষ্কার হওয়া দরকার। কথায় কথায় উপদেষ্টার নাম এবং রেফারেন্স ব্যবহার করা চিরতরে বন্ধ করা হোক। শুধু দল নয়, দেশের প্রতিটা সেক্টরে সুবিধাবাদীদের রাজত্ব। অতি দ্রুত এই রাজত্বের অবসান হোক। প্রতিটা সেক্টরে যোগ্য, দক্ষ এবং পরীক্ষিতরা মূল্যায়িত হোক এবং সেটা আজ এই মুহূর্ত থেকে শুরু হোক। লোকবল দরকার হলে ক্রাউড সোর্সিং করুন।
ঢাকা বিমান বন্দরে প্রবাসী শ্রমিকদের আলাদা মর্যাদা দেয়ার ব্যবস্থা করুন, বিমান এর টিকেট কালোবাজারী থেকে মুক্ত করুন। বিমানের যে এজেন্টরা টিকেট অগ্রীম বুক করে তারা যদি ২০ মিনিটের মধ্যে অর্থ পরিশোধ না করে তাহলে বুকিং ক্যান্সেল করুন। কোন এজেন্ট এর বুক করা টিকিট অফেরৎ যোগ্য করুন। এয়ারপোর্ট থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের জন্য প্রাইভেটকার, নোহা, মাইক্রোবাস এর ভাড়া নির্ধারিত করে দিন এবং এগুলোর বুকিং কাউন্টার এয়ারপোর্ট ভবনের ভিতরে রাখার ব্যবস্থা করুন।
বঙ্গবন্ধুর যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যাত্রা শুরু করেছিল সেই আওয়ামী লীগকে কী করে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা গিলে খেল? একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরিবর্তে কী দেখলাম আমরা? এখানে বাউলরা নির্যাতিত। তাদের ঘর, বাদ্যযন্ত্র ভেঙে দেওয়া হয়। ধর্মের অপব্যাখ্যা ও উন্মাদনা ছড়ানো ওয়াজ মাহফিলে প্রধান অতিথি হন আওয়ামী লীগের এমপি ও নেতারা। থানা ও জেলা শহরের লাইব্রেরিগুলোর কী অবস্থা? সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্রগুলো অযত্ন-অবহেলায় অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। আওয়ামী সরকারের গত ১৬ বছরে সবচেয়ে উপেক্ষিত সংস্কৃতি অঙ্গন।
বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো কেন বিএনপি-জামায়াতের রাজত্ব? প্রধানমন্ত্রী বিটের কয়জন সাংবাদিকের ব্যাকগ্রাউন্ড ঠিক আছে? কারা এদের পৃষ্ঠপোষক? অনেক মন্ত্রী, এমপি এবং নেতার পরিবারের সদস্যদের বিতর্কিত ভূমিকা ছিল এই কোটাবিরোধী আন্দোলনে। তাদের বিরুদ্ধে দল কি কোনো ব্যবস্থা নেবে?
প্রগতিশীলদের সংগঠন গৌরব ’৭১-এর সমাবেশ ছিল ১৭ জুলাই বিকাল ৪টায় শাহবাগে। ওইদিন সকাল থেকে তাদের সমাবেশ করতে মানা করা হয়। বলা হয় এটা অনেক রিস্ক হয়ে যাবে, আপনাদের ওপর হামলা হতে পারে। তারা সব উপেক্ষা করে ওইদিন শাহবাগ দাঁড়ায়। আমন্ত্রিত অতিথিদের অনেকেই গা বাঁচাতে সে সমাবেশে আসেননি। তারপরও ওইদিন তাদের সমাবেশটা বেশ সফলভাবে শেষ করে। তাদের ওই সমাবেশে সত্যি সত্যিই বাধা দেওয়া হয়েছিল। তবে জামায়াত-বিএনপি না, আওয়ামী লীগ নামধারীরাই বাধা দিয়েছিল। এখানেই শেষ হয়। দুই দিন পর গৌরব ’৭১-এর সাধারণ সম্পাদক এফ এম শাহীনকে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ে গুলি করা এবং জবাই করার হুমকি দেয় ওই একই ব্যক্তি। পাঁচ দিন পার হলেও আওয়ামী লীগের নেতারা কোনো বিচার করেননি। চাইলেই হত্যাচেষ্টা মামলা করা যেত। ঘৃণায় সেটাও করা হয়নি। আওয়ামী লীগের সব বড় বড় কুতুব যখন গর্তে ঢুকেছিল তখন গৌরব ’৭১ এবং শাহীন মাঠে ছিল। তার খুব ভালো প্রতিদান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দিয়েছে। এভাবেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দিন দিন একা হয়েছে।
প্রতিটা স্তরে কমিটি বাণিজ্য সংগঠনকে একেবারে শেষ করে দিয়েছে। কমিটি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। ছাত্রলীগকে একটা গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এমন ঠুঁটো জগন্নাথ বানানো হয়েছে। একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে সুকৌশলে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। এদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। মাঠের কর্মীদের রোদে পোড়া চেহারা, শরীরে ঘামের গন্ধ এমপি-মন্ত্রী নেতাদের ভীষণ অপছন্দ। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া বাংলাদেশ ছাত্রেলীগের সর্বস্তরে ২৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি চাই। চকচকে চেহারা, পারফিউম মেখে ঘুরে বেড়ানো লোকজন চিহ্নিত করে ছাটাই করার পদক্ষেপ নিন। প্রতিটা এমপি, মন্ত্রী, নেতার পাশে আপনি কোনো দুর্দিনের কর্মী পাবেন না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই বেহাল দশায় দেশের প্রতিটি বোধসম্পন্ন, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক নাগরিকের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। তারা এখনো প্রচন্ড আশা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা বিশ্বাস করে গর্বের পতাকা এবং সার্বভৌমত্ব দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাতেই সবচেয়ে নিরাপদ। জয় বাংলায় জীবন শুরু-জয় বাংলায় তা শেষ করতে চাই।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক ৭১ এর গেরিলা ও মুক্তিযুদ্ব গবেষক